‘সেই যে গেলাম আর ১৭ ডিসেম্বর ফিরে এলাম বিজয়ের বেশে’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীতে নেতৃত্ব দেন। প্রবীণ এই রাজনীতিক আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার দেন, যেখানে তুলে ধরেন দীর্ঘ রাজনীতির পথ-পরিক্রমার নানা দিক। স্মৃতিমন্থন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধেরও। বিজয় দিবস উপলক্ষে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা আলোচনার খণ্ডাংশ তুলে ধরা হলো।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

প্রশ্ন: দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীকার আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিল, যার নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২৫ মার্চ কোথায় ছিলেন, কী দেখলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ১ মার্চের পর আমরা শহীদ মিনারে বিকেলে নিয়মিত সমাবেশ করতাম। ২৪ মার্চ দুপুর থেকেই শহরে এক প্রকার আতঙ্ক, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রাতে কিছু একটা হবে তা অনুমান করা যাচ্ছে। আমরা ওই সমাবেশ থেকে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে সমাবেশ ভেঙে দিলাম। আমি হল ছেড়ে হাতিরপুলে একটি বাসায় গিয়ে অবস্থান নিলাম। সন্ধ্যায় গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আমাদের কাছে ব্লুপ্রিন্ট ছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল আর্মি মুভ করার আগেই ঢাকায় ঢুকতে যে কালভার্টগুলো আছে তা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে। আমি টেলিফোনে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম যে, আমরা কী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবো? তারা সম্মতি দিলেন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। হাতিরপুলের ওই বাসায় শিল্পী কামরুল হাসান এবং আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন। কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আমার তর্ক লেগে যায়। হাতিরপুলে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তি দিলেন কালভার্ট উড়িয়ে কোনো সমাধান হবে না, বরং আমাদের হাতিরপুল এলাকা রক্ষা করাই প্রধান কাজ হবে। আমি বললাম, পুরো ঢাকা দখল হয়ে গেলে হাতিরপুলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন: পরে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: মীমাংসা না হওয়ায় আমরা আমাদের কর্মীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দেশনা দিলাম। ককটেল বানানোর জন্য দুই ড্রাম কেরোসিন ও পেট্রল, কয়েকশ কাচের বোতল এবং কিছু কাপড় নিয়ে আমি যে বাসায় উঠেছি সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতির আগেই আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। রাত ১১টার দিকেই আর্মিরা শহরে প্রবেশ করে এবং রাত ১২টার পর অপারেশন শুরু করে।

হাতিরপুলের পাশ দিয়ে একটি রেললাইন ছিল এখন যেটি কাঁটাবন রাস্তা। রেললাইনের দুই পাশে বস্তি ছিল। পাকিস্তানি সেনারা সব জ্বালিয়ে দিলো। আমরা পাশেই একটি তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে আগুন, মানুষের কান্না দেখতে পেলাম। মাথার ওপর দিয়ে অসংখ্য গুলি চলে যাচ্ছে। কঠিন এক ভয়ার্ত পরিবেশ। তখন আমরা বুঝতে পারলাম আধুনিক একটি সেনাবাহিনীর বিপরীতে আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না এবং আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে যেতে হচ্ছে।

প্রশ্ন: পেট্রল, কেরোসিন কী করলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: হাতিরপুলে এখন যেখানে কাঁচাবাজার সেখান থেকে আর্মি ফায়ার করছে। পাশেই একটি টিনশেড বাড়িতে আমাদের অবস্থান। তল্লাশি হতে পারে এই আশঙ্কায় রাতেই আমরা কেরোসিন, পেট্রোল বালতিতে করে ড্রেনে ফেলে দিলাম। বোতল, কাপড় সরিয়ে ফেললাম। বুঝলাম, এই উপকরণ দিয়ে কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, আরও বিপদ ডেকে আনা।

প্রশ্ন: পরের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সমাবেশের কী হলো?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশনের পর ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যায়। চারদিকে হত্যা আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মানুষ দিশেহারা। অভিযানের ব্যাপারে ধারণা করেছিলাম কিন্তু এমন হত্যাযজ্ঞ হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। মধ্যরাত থেকেই কারফিউ চলছে। বাইরে বেরুলেই গুলি করা হচ্ছে। বস্তি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন তো গণহত্যা চলছে। এ অবস্থায় সমাবেশের কথা চিন্তাই করতে পারিনি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।

প্রশ্ন: হাতিরপুলের বাসায়ই থেকে গেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দুপুরের পর কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে গেলাম। সারি সারি লাশ দেখে দম বন্ধ হয়ে এলো। এরপর পার্টির অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হলো। তারা সর্বোচ্চ শক্তি সঞ্চয় করতে বললেন এবং আপাতত নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বললেন। এরপর বাড়িতে গেলাম এবং ছোট একটি ব্যাগে লুঙ্গি, গামছা, ব্রাশ নিয়ে বের হলাম। সেই যে গেলাম আর ফিরে এলাম ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের বেশে। সেই ব্যাগ ও আমার ব্যক্তিগত স্টেনগানটি সঙ্গে ছিল।

প্রশ্ন: নিরাপদ জায়গা কোথায় পেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি ঢাকার অদূরে ত্রিমোহনী (খিলগাঁওয়ের পেছনে) এলাকায় চলে গেলাম। এর আগের বছর ওই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টানা এক মাস ত্রাণ বিতরণ কাজে সহযোগিতা করেছিলাম। সেখানকার প্রতিটি বাড়িই পরিচিত ছিল। পার্টির অন্য নেতাদেরও থাকার ব্যবস্থা করলাম। এখানে তিন-চারদিন থাকলাম। এরপর পার্টির পক্ষ থেকে নির্দেশনা এলো, চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিতে হলে ভারতে আশ্রয় নিতে হবে এবং ত্রিমোহনী এলাকা ছেড়ে দিতে বলা হলো।

প্রশ্ন: ত্রিমোহনী ছেড়ে কোথায় গেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমরা নরসিংদীর মনোহরদীতে গিয়ে এক সপ্তাহ থাকলাম। সেখান থেকে আবার আরেকটি জায়গায় গিয়ে পার্টির নেতাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। সেখানে কমরেড মনি সিং, কমরেড ফরহাদও ছিলেন। নেতাদের পরামর্শ ও নির্দেশনা নিয়ে পরদিন ভোরবেলা আখাউড়া সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলা চলে গেলাম।

প্রশ্ন: এরপর...

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমরা প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যাই। এরপর আগরতলা কলেজে অবস্থান নেই। পরে ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপের আরও সদস্য চলে এলে আগরতলায় একটি হোস্টেলে উঠি।

প্রশ্ন: প্রশিক্ষণ কী সেখানেই নিলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যে বাহিনী (এসএফ) সেখানে প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের নেওয়া হতো না। স্থানীয় এমপি বা এমএলএ-এর সুপারিশ ছাড়া কেউ সদস্য হতে পারলাম না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ শুধু সুযোগ পেলো। তবে খালেদ মোশাররফ গোপনে আমাদের কাউকে কাউকে সুযোগ দিয়েছিলেন। এজন্য প্রশিক্ষণ নেওয়া খুবই কঠিন ছিল।

প্রশ্ন: তাহলে প্রশিক্ষণ নিলেন কীভাবে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভারত সরকার ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সদস্যদের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করে আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলো।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার জন্য এক হয়ে কাজ করার কথা। কিন্তু সেখানেও কেন আলাদা প্রশিক্ষণ? কেন এই বিভাজন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন তাজউদ্দিনবিরোধী অংশটি সক্রিয়। তারা তাজউদ্দিনকে উচ্চবিলাসী আখ্যা দিয়ে নিজেদের আসল আওয়ামী লীগ দাবি করলেন এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদেরই অগ্রাধিকার দিতে বললেন। অপরদিকে ভারত সরকার দেখলো একটি প্রশিক্ষিত গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ফলাফল বামপন্থিদের পক্ষে যাবে। ভিয়েতনামের মতো হতে পারে। সঙ্গত কারণে ভারতের বুর্জোয়া সরকার তা চাইবে না। এসব দিক বিবেচনা করে ভারত সরকার বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত তাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলো। এই সময় ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার কিছু কিছু বিষয়ে চুক্তি হয়। এরপরেই ভারত সরকার সম্মত হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপের সদস্যদের নিয়ে একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করে অতিগোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। আমাদের মধ্য থেকে প্রথম যে ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নেওয়া হয় সেখানেই আমি ছিলাম।

প্রশ্ন: প্রশিক্ষণ নিতে কোথায় গেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আসামের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম ব্যাচে দুইশ জন ছিলাম। ওই ব্যাচে আমি ডেপুটি কমান্ডার ছিলাম। পরে আরও চারশজনের একটি ব্যাচ আসে। এভাবে প্রায় দশ হাজার সদস্যকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের কমান্ডার ছিলেন ওসমান গণি। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। নুরুল ইসলাম নাহিদ ছিলেন সভাপতি।

প্রশ্ন: নুরুল ইসলাম নাহিদও কি গেরিলা প্রশিক্ষণ নিলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না। তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি। নাহিদ ভাই কলকাতায় অবস্থান করে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় অংশ নেন।

প্রশ্ন: প্রশিক্ষণ নিয়ে কোথায় এলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আগরতলা ছিল গেরিলা বাহিনীর বেসক্যাম্প। প্রশিক্ষণ নিয়ে সবাইকে এখানে আসতে হতো। এরপর ১০ থেকে ১৫ জনের গ্রুপ তৈরি করে অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হতো। পুরো বাহিনীর জন্য অপারেশন প্ল্যানিং কমিটি (ওপিসি) ছিল। এই কমিটির আমিই ছিলাম একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য। আমি প্রতিটি অপারেশনের সার্বিক খোঁজ-খবর নিতাম। আমাদের প্রশিক্ষণ ছিল দীর্ঘমেয়াদের কিন্তু নভেম্বরেই বুঝতে পারি যুদ্ধ আর বেশিদিন হবে না।

প্রশ্ন: গেরিলা যুদ্ধের এমন কোনো ঘটনা যা আজও স্মৃতিপটে বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ১১ নভেম্বর আমাদের গেরিলা বাহিনীর জন্য একটি ট্র্যাজেডির দিন। কুমিল্লার একটি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে নিজাম উদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মুনিরসহ ৯ জন কমরেড মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের পুরো বাহিনীই অ্যাটাক হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানসহ অনেকেই ছিলেন। পরে প্রাণে বেঁচে তারা ঠিক জায়গায় চলে আসে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারও যুদ্ধে যায়।

প্রশ্ন: আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ঘটনাক্রমে ওই অপারেশনের নির্দেশনায় আমি ছিলাম না। আমাকে দুদিনের জন্য কলকাতায় যেতে হয় এবং এটিই ছিল আমার প্রথম কলকাতা সফর। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং উপলক্ষে আমি কলকাতায় যাই। ফিরে এসে এই ট্র্যাজেডির কথা শুনি। এরই মধ্যে যুদ্ধের পরিধি এবং ব্যাপকতাও বেড়ে গেছে।

প্রশ্ন: আপনারা কী বেসক্যাম্পেই রয়ে গেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না। আমরা চূড়ান্ত আক্রমণের লক্ষ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ করলাম। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমি প্রায় তিনশ সদস্যের একটি বাহিনী নিয়ে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হলাম। ভারত যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হওয়ার দু-তিনদিনের মধ্যেই আমরা সীমানা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

প্রশ্ন: রুট কোনটি ছিল?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ১২ ডিসেম্বর আমরা মুন্সিগঞ্জে চলে আসি। কৌশল ছিল পাকিস্তান বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা ঘিরে ফেলা। ১৩ ডিসেম্বর বের হয়ে দোহার, শ্রীনগর এবং নবাবগঞ্জের মধ্য পয়েন্ট চুরাইন নামে একটি জায়গা আছে সেখানে অবস্থান নেই। পরদিন পরিকল্পনা অনুয়ায়ী সেখান থেকে মাহবুব জামানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ গজারিয়া দিয়ে ঢাকার দিকে মুভ করলো। এর একদিন পর আমরা বড় গ্রুপটি নিয়ে কেরানীগঞ্জ বুড়িগঙ্গার পাশে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি আমাদের কানে আসছে। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর রেডিওতে প্রচার হলো পাকিস্তান বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

প্রশ্ন: আপনারা কী ১৬ ডিসেম্বরেই ঢাকায় এলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না। প্রস্তুতি নিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ভারী অস্ত্র নিয়ে রাতে আর মার্চ করতে মন চাইলো না। পরদিন ভোরে রওয়ানা হলাম। সকাল ১০টার দিকে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নাজিমউদ্দিন রোড দিয়ে জেলখানার সামনে চলে এলাম। জেলখানা থেকে তখন সরদার ফজলুল করিম, ইকবাল আহমেদসহ অনেকেই ছাড়া পেয়েছেন। রাস্তায় তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। চারদিকে আনন্দ যেন ধরছে না। আবার শোকের ছায়াও বয়ে যাচ্ছে। আমরা শহীদ মিনারে এসে শপথ নিলাম। সম্ভবত নিয়মিত বাহিনীর বাইরে আমরাই প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করি। এরপর বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে দুপুরের দিকে নয়াপল্টনের বাসায় চলে গেলাম।

প্রশ্ন: বাসায় সবাইকে কেমন পেলেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি জীবিত ফিরে এসেছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। উদ্বিগ্নতা সবার মধ্যেই ছিল। তবে আমার পরিবারে সবাই বাস্তববাদী। মার্চ মাসে ঢাকার রাজপথে অস্ত্র হাতে প্রথম যে কুচকাওয়াজ হয় সেখানে আমার বোনেরাও ছিলেন, যে ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পায়। যুদ্ধের সময় আমার বোনেরা ঢাকায় আরবান গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তারাও যুদ্ধে অংশ নেন। এ কারণে আবেগের চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতিকে পরিবার গুরুত্ব দিয়েছে।

প্রশ্ন: যুদ্ধের ৯ মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না। আমি কয়েকটি চিঠি বাড়িতে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। অবশ্য আমার কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না।

প্রশ্ন: নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কী বলবেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। আসলে ইতিহাস জোর করে তৈরি করা যায় না। ইতিহাস তার নিজের গতিতে তৈরি হয়। এ কারণে আমি ইতিহাস তৈরি করার জন্য সব প্রস্তুতি সেরে একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য নির্দেশ দিতে পারি না। আমি বলবো, কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তুতি ছিল আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তুতি ছিল না।

প্রশ্ন: এখানেই যদি একটি তুলনা করে বলতেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আদর্শগত প্রস্তুতির বড় ঘাটতি ছিল। আমরা যে, পাকিস্তানি মতাদর্শের বিপরীতে একটি ভিন্নধারা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারিনি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শর্টকাট মেথড (সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি) নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ বরাবরই লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন চেয়েছে। লাহোর প্রস্তাবে দ্বি-জাতি তত্ত্ব গুরুত্ব পায় এবং এটিই একটি সাম্প্রদায়িক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের আগে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমরা সচেতন করে তুলতে পারিনি।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার পরে তো সুযোগ ছিল? তখন পারলেন না কেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: স্বাধীনতার পরে যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা অসম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে এগোতে পারেনি। সরকারই তখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন: কেন এই উপলব্ধি?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধান রচনা করেছে ঠিক কিন্তু তারা এই সংবিধানের মর্মকথা গ্রহণ করেনি। সংবিধানকে কিতাব হিসেবে রেখে তারা উল্টো কাজ করতো। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে মাথানত করতে থাকে। তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। তারা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তারা কম্বল চুরির কাজে নিয়োজিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তিনি পেয়েছিলেন চোরের খনি। বঙ্গবন্ধুর নিজের কম্বলটিও নাকি চুরি হয়েছিল।

এএসএস/এএসএ/এমআইএইচএস



https://ift.tt/cmOYiwn
from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/YD5PzBE
via IFTTT
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url